ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রপ্তানীর শর্ত ভঙ্গ এমভি প্রিন্সেস জাহাজের

স্বাস্থ্যঝুঁকির অ্যাসবেসটস নিয়ে এমভি প্রিন্সেস জাহাজকে চট্টগ্রামের শীপ ইয়ার্ডে আমদানীর চেষ্টা

Passenger Voice    |    ০৩:১৯ পিএম, ২০২১-০৮-২০


স্বাস্থ্যঝুঁকির অ্যাসবেসটস নিয়ে এমভি প্রিন্সেস জাহাজকে চট্টগ্রামের শীপ ইয়ার্ডে আমদানীর চেষ্টা

সামসুদ্দীন চৌধুরীঃ ১৯৭৪ সালে তৈরি যাত্রী পরিবহনকারী COMOROS এর পতাকাবাহী PASSANGERS RO-RO VESSEL MV PRINCESS (IMO NO-7347548)  জাহাজটি ভাঙ্গার জন্য চট্টগ্রামের মেসার্স আরএস শিপিং এজেন্সীজ মাধ্যমে আমদানী করছে একটি প্রতিষ্ঠান। 

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা)  এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে  MV PRINCESS (IMO NO-7347548)  জাহাজটি বাংলাদেশে ভাঙ্গার জন্য আমদানি করা হচ্ছে। ৪৭ বছর আগে নির্মিত এ জাহাজটিতে বিপুল পরিমাণ অ্যাসবেসটস উপস্থিতি থাকবেই যা ভাঙ্গার সময় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশ দুষণ ও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই সংগঠনটি দাবী করেন বাংলাদেশের কোন শীপ ইয়ার্ডে অ্যাসবেসটস দূষণ মোকাবেলা করার সক্ষমতা নেই। এই জাহাজ আমদানি রোধ করা না গেলে অ্যাসবেসটস শ্রমিকের দেহে প্রবেশ করে এবং আশেপাশে ছড়িয়ে পরে প্রাণঘাটি এসবেসটোসিস ও ফুসফুস ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে। 

অন্যদিকে COMOROS এর পতাকাবাহী PASSANGERS RO-RO VESSEL MV PRINCESS (IMO NO-7347548)  জাহাজটি ব্যবহারিক আয়ুষ্কাল শেষে অবৈধ রপ্তানীর বিষয়ে ভারতে গুরুগ্রামে অবস্থিত INFORMATION FUNCTION CENTRE কে অবগত করে ইন্টারপোল। বিষয়টি ইন্ডিয়ান হাইকমিশন হতে গত ৯ আগষ্ট বাংলাদেশ সরকারকে অবগত করেছে বলে প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্রের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের ১৬ আগষ্ট এমভি প্রিন্সেস জাহাজটি গ্রীসের কালাকোলম বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে পথিমধ্যে জাহাজটি ০৪ (চার) বার পরিচয় পরিবর্তন করেছে। এছাড়াও জাহাজটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রপ্তানীর শর্ত ভঙ্গ করেছে বলেও প্যাসেঞ্জার ভয়েসের সূত্র নিশ্চিত করেছে। জাহাজটি ১৬ আগষ্টের মধ্যে শীপ ব্রেকিংয়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় প্রবেশের কথা থাকলেও এখনও জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে পারেনি। এরই মধ্যে গত ১৮ আগষ্ট এমভি প্রিন্সেস জাহাজটিকে চট্টগ্রাম বন্দরে আগমনে বিরত রাখতে আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স  আরএস শিপিং এজেন্সীজকে নির্দেশ দিয়ে পত্র প্রদান করেন। 

কেন জাহাজটির বিষয়ে পরিবেশ আইনবিদদের আপত্তিঃ 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়েরকৃত উচ্চ আদালতের ৭২৬০/২০০৮ এবং ৮৬৬৪/২০১৭ নং মামলার রায়ে বলা হয়েছে স্বচ্ছতার সাথে, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যথাযথভাবে বর্জ্যমুক্ত না করে কোন জাহাজ আমদানি করা যাবে না। এছাড়া মহামান্য আদালত বেশ কিছু মামলার রায়ে সুনিদিষ্টভাবে অ্যাসবেসটসের ঝুঁকি থেকে জাহাজভাঙ্গা শ্রমিক এবং পরিবেশকে বাঁচাতে নির্দেশ প্রদান করেছে।

তবে সংগঠনটির দাবী জাহাজভাঙ্গা কর্মকান্ডের জন্য জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে উচ্ছ আদালতের নির্দেশনা লংঘন হচ্ছে।  জাহাজ আমদানি, সৈকতায়ন এবং ভাঙ্গার ক্ষেত্রে এমনকি আদালতের নির্দেশে প্রণীত বিপজ্জনক বজ্য ও জাহাজভাঙ্গার বজ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১১ এবং THE SHIP BREAKING AND RECYCLING RULES 2011 এর বিধানাবলী লঙ্ঘন করা হয়।

সংগঠনটি আরো বলেন,বাংলাদেশে জাহাজভাঙ্গার ইয়ার্ডগুলোতে এসবেসটসের মত দূষণকারী পদার্থ ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম সুবিধাদি নেই। এই ইয়ার্ডগুলো থেকে এসবেসটোসিসের মতো প্রাণনাশী রোগে আক্রান্ত হতে পারে এলাকাবাসী। হুমকিতে পড়বে জনস্বাস্থ্য। জাহাজভাঙ্গা কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও উদাসীনতার কারনে কর্মরত শ্রমিকরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারনে প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করছে।

এই বিষয়ে মেসার্স আরএস শিপিং এজেন্সীজ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিক প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, জাহাজটির বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে চিঠি চালাচালি হচ্ছে। বিষয়টি সুরাহা হলে জাহাজটি বাংলাদেশে আসবে। এমভি প্রিন্সেস জাহাজটি চট্টগ্রামে বন্দরে আগমনে বিরত থাকার চট্টগ্রাম বন্দরের চিঠির বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। কোন প্রতিষ্ঠান আমদানী করছে জাহাজটি এমন প্রশ্নে তিনি কোন উত্তর দেননি। তবে তিনি দাবী করেন এমভি প্রিন্সেস জাহাজটিতে কোন ধরনের এসবেসটস নেই বলে এজেন্সীজকে নিশ্চিত করেছে আমদারীকারক প্রতিষ্ঠান। 

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ফাউন্ডেশনের (ওশি) ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১০০ জন জাহাজভাঙা শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা করেন। ওই পরীক্ষায় ৩৩ জন জাহাজভাঙ্গা শ্রমিকের অ্যাসবেসটোসিস ধরা পড়ে। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জাহাজভাঙা কারখানায় কাজ করছেন ও যাঁরা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন কিংবা যারা ধূমপায়ী তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, খনিজ তন্তু অ্যাসবেসটস শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ অ্যাসবেসটোসিসে আক্রান্ত হয়। শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে (অ্যাসবেসটোসিস) ফুসফুসের ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সংস্থাটির একটির সূত্র বলছে,, জাহাজভাঙ্গা শ্রমীকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের চেন্নাই মেডিকেল ইউনিভার্সিটির জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুরলি ধর। তিনি জানান, অ্যাসবেসটস খনিজ তন্তু, যার তাপ সহ্য করার ক্ষমতা আছে। অ্যাসবেসটস জাহাজে ব্যবহার করা হয়। এই পদার্থ আগুন ও পানিতে ধ্বংস হয় না। তিনি জানান, শক্ত অ্যাসবেসটস কাটার সময় পাউডার আকারে বাতাসে উড়তে থাকে। পরে শ্রমিকের নিশ্বাসের সঙ্গে সেগুলো ফুসফুসে ঢুকে যায়। এভাবে শ্রমিকেরা অ্যাসবেসটোসিসে আক্রান্ত হন। এই রোগের বাহ্যিক কোনো লক্ষণ নেই। আক্রান্ত শ্রমিকের দীর্ঘদিন পর শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এমনকি ফুসফুসে ক্যানসারও হতে পারে।

নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন আহমেদ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, এমভি প্রিন্সেস জাহাজটিতে এসবেসটস নামের একটি দূষণ রয়েছে। যা মানবদেহের ক্ষতি করে। এই জাহাজটি চট্টগ্রামে আসলে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়বে এবং দেশের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তাই জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে না আনতে  মেসার্স  আরএস শিপিং এজেন্সীজকে নির্দেশ দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। নির্দেশ অমান্য করে চট্টগ্রামে আসলে জাহাজটি বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গুগুল থেকে জানা যায়ঃ ১৯৪০ সাল থেকে অ্যাসবেসটস পেশাজনিত রোগের একটি কারণ বলে স্বীকৃত হলেও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানো হয়নি৷ চিকিৎসকরা তখনই জানিয়েছিলেন যে, স্বরযন্ত্রের ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার ও ফুসফুসের বহু রোগ শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে অ্যাসবেসটস ঢুকে পড়তে পারে৷ কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নে অ্যাসবেসটস নিষিদ্ধ করতে দীর্ঘ ৬০ বছর গড়িয়ে যায়৷ মাত্র ২০০৫ সাল থেকে অ্যাসবেসটস বাড়িঘর তৈরির কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ কিন্তু অন্যান্য দেশে এখনও স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক এই পদার্থটি ব্যবহৃত হচ্ছে৷ দুঃখের সঙ্গে জানান বিজ্ঞানী রোল্ফ পাকরোফ৷ তাঁর কথায়, ‘‘সারা বিশ্বে এই খনিজ পদার্থের উত্পাদন ১৯৮৮ সাল থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ নিষিদ্ধ করার কারণে ইউরোপে অ্যাসবেসটসের ব্যবহার করা হচ্ছেনা৷ দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে৷ কিন্তু সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন, চীন, ও ক্যানাডায় অ্যাসবেসটসের উৎপাদন হচ্ছে এখনও৷''